সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করায় চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে উত্তেজনাকর। নতুন এ শুল্ক বৃদ্ধির আগে চীনের ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ শতাংশ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ট্রাম্প আরো ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আগামী জুন নাগাদ আরো ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যের ওপর এ শুল্ক আরোপ করা হবে। এই নতুন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে আলোচনার যে শুভ সূচনা হয়েছিল, তা অংকুুরেই বিনষ্ট হলো সে কথা হলফ করেই বলা যায়। পাল্টা জবাব হিসেবে চীন ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে।
দুই দেশের এ বাণিজ্যযুদ্ধ শুধু শুল্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। হুয়াওয়ের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বিমাতাসুলভ আচরণ, তার খানিকটা যে বর্তমান বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হুয়াওয়ের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশেই কানাডায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। আর অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে হুয়াওয়েকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে এবং মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে যারা হুয়াওয়ের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে যুক্ত, তারা যেন সেই সম্পর্ক অতি দ্রুতই ছিন্ন করে। আর তারই ধারাবাহিকতায় গুগল, ইন্টেলসহ আরো কিছু প্রধান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে হুয়াওয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
এবার একটু খতিয়ে দেখা যাক চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রধান কারণ। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশটির রফতানি বেড়েছে অনেকাংশে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে চীনের মোট রফতানি ছিল দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ, যা বেড়ে ২০০৮ সালে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশ। যদিও পরবর্তীকালে রফতানি কিছুটা কমে ২০১৭ সালে আবার ২০ শতাংশে নেমে আসে। সেই রফতানির সিংহভাগই হয় মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে। চীনের মোট রফতানির প্রায় ২০ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। আর সেখানেই মার্কিন নীতিনির্ধারকদের যত ক্ষোভ। ২০১০ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি, যা ২০১৮ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে। মোট দেশজ উৎপাদন যদি উন্নয়নের মাপকাঠি হয়, তবে ‘নিট রফতানি’ (রফতানি থেকে আমদানি বাদ দিলে যা থাকে) একটি দেশের দেশজ উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির অর্থ দাঁড়ায়, যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা চীনে রফতানি করে, তার চেয়ে বেশি চীন থেকে আমদানি করে। তাতে দেশটির দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পায়, যা কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই যেকোনো মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক সমতা আনতে বদ্ধপরিকর।
তবে একথা ভাবাও ঠিক হবে না, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত, সেটা সম্পূর্ণ মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রভাব। এখানে চীনের হস্তক্ষেপ রয়েছে। সেটা হচ্ছে চীনের মুদ্রার (রেনমিনবি) বিনিময় হার মার্কিন ডলারের বিপরীতে অনেকটা কৃত্রিমভাবেই স্থির (পেগিং) করে রাখা হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাণিজ্যযুদ্ধের প্রধান কারণ।
মুক্তবাজার অর্থনীতির যে নীতি, তার আলোকে বলা যায়, যেকোনো দেশের রফতানি যদি তার আমদানির চেয়ে বেশি হয় অর্থাৎ কোনো দেশ যদি ‘নিট রফতানিকারক’ দেশ হয়, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে সেই দেশের মুদ্রার চাহিদা বাড়বে। একটা নির্দিষ্ট জোগানের বিপরীতে যদি কোনো মুদ্রার চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে যায়, তবে সেই মুদ্রার মূল্যমান বৃদ্ধি পাবে। বিনিময় হারে মুদ্রার মান বৃদ্ধিতে সেই দেশের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হবে। এ অবস্থায় সেই দেশের পণ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছুটা বাজার (মার্কেট শেয়ার) হারাবে, যেটা স্থানীয় সরবরাহকারীদের দখলে চলে যাবে। তদ্রূপভাবে কোনো দেশ যদি ‘নিট আমদানিকারক’ দেশ হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে সেই দেশের মুদ্রার জোগান বেড়ে যাবে। ফলে সেই মুদ্রার অবমূল্যায়ন হবে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। ফলে স্থানীয় বাজারে আমদানিকৃত পণ্য কিছুটা বাজার হারাবে আর স্থানীয় উৎপাদনকারীরা কিছুটা সুবিধা পাবেন। এভাবে মুদ্রার বিনিময় হারের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে একটা দীর্ঘমেয়াদি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
এবার চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিনিময় হারের দিকে আসা যাক। ১৯৯৫ সালে দুই দেশের মুদ্রার মান ছিল ১ ডলারের বিপরীতে প্রায় ৮ দশমিক ৩ রেনমিনবি, যা পরবর্তী এক দশকেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানির পরিমাণ বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি (প্রায় ৫৩৫ শতাংশ)। ক্রমাগত মার্কিন চাপের প্রভাবে চীন তার মুদ্রার মান বাড়াতে বাধ্য হয় ২০০৫ সালে। তবে ২০০৫ সাল থেকে ২০০৮, এ তিন বছরে বিভিন্ন ধাপে রেনমিনবির মূল্যমান ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১ ডলারের বিপরীতে প্রায় ৬ দশমিক ৮ রেনমিনবি। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সামান্য ওঠানামা ছাড়া দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় হারের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য তারতম্য ঘটেনি, যদিও এই একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানি বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
এখানেই মার্কিন নীতিনির্ধারকদের যত অভিযোগ। তাদের মতে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে রেনমিনবির মান যদি কৃত্রিমভাবে স্থির (পেগিং) করে না রাখা হতো, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে রেনমিনবির মূল্যমান অনেক গুণে বেড়ে যেত। এতে চীনের পণ্য মার্কিন মুলুকে তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল হতো। সেই সুযোগে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা চীনের হারানো অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নিত, যার ফলে দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদি সমতা আসত। কিন্তু পেগিংয়ের কারণে বাজারের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এ ধারণাই মূলত চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করে। যেহেতু চীন ডলারের বিপরীতে রেনমিনবির মূল্যমান বাজারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, যুক্তরাষ্ট্র তাই চীনের রফতানির ওপর শুল্ক আরোপ করে কিছুটা হলেও বদলা নিতে চাইছে।
দুই দেশের এই তীব্র বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে কার লাভ হচ্ছে আর কার ক্ষতি, সেটা খতিয়ে দেখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের এটা বিশ্বাস যে শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন কোষাগার লাভবান হচ্ছে। আদতেই কি তাই? শুল্ক আরোপের ফলে চীনের পণ্য ও সেবার দাম মার্কিন মুলুকে বেড়ে যাওয়ার কথা। সে হিসাবে চীনা রফতানিকারকরা মার্কিন বাজার হারাবে। আর যদি সেই বাজার পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে তাদের পণ্য ও সেবার দাম কমাতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। গবেষণায় প্রকাশ যে মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের দাম কমেনি। তার মানে, চীনা রফতানিকারকরা শুল্কের বোঝা মার্কিন ভোক্তাদের ওপর চাপাতে সমর্থ হয়েছে।
তবে শুল্ক আরোপের প্রধান নেতিবাচক দিক হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্যের ফলে ভোক্তা ও উৎপাদনকারী যে বাড়তি উপযোগ বা সুবিধা পায়, সেটার বিলুপ্তি। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর ‘তুলনামূলক সুবিধা’ তত্ত্ব বর্তমান যুগেও অর্থনীতির একটি সর্বজনীন ও জুতসই তত্ত্ব বলে সমাদৃত। তত্ত্বের সারকথা হলো, কোনো একটি দেশ সেই পণ্য বা সেবা উৎপাদনে মনোনিবেশ করবে, যেখানে তার তুলনামূলক সুবিধা আছে। আর অন্য সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করবে। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, শুল্কমুক্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদন হবে, শুল্ক আরোপের ফলে উৎপাদন তার চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম হবে। অর্থাৎ শুল্ক আরোপের ফলে কিছু উৎপাদক, যারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্যে অর্থনৈতিকভাবে বাজারে টিকে থাকতে সক্ষম, তারা আর টিকে থাকবে না। ফলে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ভোক্তারা সেই পণ্য বা সেবা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হবে।
এ তত্ত্বের আলোকে দেখা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের যেসব পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, সেসব পণ্যের দাম মার্কিন মুলুকে বেড়ে যাওয়ায় অনেক চীনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে। আবার মার্কিন ভোক্তারা এই একই পণ্য স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে মার্কিন পণ্যের ওপর চীনের প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ একই প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উৎপাদন বা সেবা প্রতিষ্ঠান চীনে তাদের বাজার হারাবে। ফলে ব্যবসাও গুটিয়ে নিতে হতে পারে। এ অবস্থায় চীনের ভোক্তারা বেশি দামে স্থানীয় পণ্য কিনতে বাধ্য হবে।
সুতরাং এটা প্রতীয়মান হয় যে শুল্ক আরোপের ফলে দুই দেশের ভোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সেই সঙ্গে দুই দেশের কিছু উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। যদি কিছু লাভ হয়, সেটা হচ্ছে যে স্থানীয় কিছু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যারা পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে অক্ষম, তারা আবার উৎপাদনে ফিরে আসবে। এতে কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির আলোকে এসব প্রতিষ্ঠান অদক্ষ। সুতরাং তাদের কর্মসংস্থান সম্পদের প্রকৃত ব্যবহারের চেয়ে সম্পদের অদক্ষ বণ্টনকে উৎসাহিত করবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি ও ফিন্যান্স বিভাগ, নিজুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান
পাঠকের মতামত: